শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর পালিত হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে, মুক্তিযুদ্ধের পরাজয় নিশ্চিত দেখে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর মতো সশস্ত্র সংগঠন একটি ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল বাংলাদেশকে মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত করা লক্ষ্যে।
এই নিকৃষ্ট অপারেশনের অংশ হিসেবে তারা কবি, লেখক, দার্শনিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে অপহরণ করতো তাদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে। অনেককেই বীভৎস নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকের লাশ মিরপুর ও রায়েরবাজারের গণহত্যাস্থলে পরিবারের সদস্য দ্বারা শনাক্ত করেন।
২৫ মার্চ, ১৯৭১ থেকে ৩১ জানুয়ারি, ১৯৭২ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে পরিকল্পিতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। এর মধ্যে দার্শনিক, সাহিত্যিক, গবেষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, খেলোয়াড়, সঙ্গীতশিল্পী এবং সংস্কৃতিজনরা ছিলেন। যারা তাদের জীবন হারিয়েছেন, তাদের স্মরণ করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর গোবিন্দ চন্দ্র দেব, প্রফেসর মুনির চৌধুরী, প্রফেসর মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, প্রফেসর গিয়াসুদ্দিন আহমেদ, উপন্যাসিক আনোয়ার পাশা, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সাংবাদিক সেলিনা পারভিন, ড. ফজলে রাব্বী, সঙ্গীতজ্ঞ ও গীতিকার আলতাফ মাহমুদ, চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক জহির রায়হান।
এই গণহত্যার মূল লক্ষ্য ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তার মুক্তমনা, গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা সম্পন্ন নেতা-ভাবুকদের বুদ্ধি-সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা। হত্যাকারীরা দেশের সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও সামাজিক কাঠামোকে দুর্বল করতে চেয়েছিল, যাতে বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম জাতি হিসেবে বিকশিত হতে না পারে। তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মননের প্রতি আঘাত হেনে জাতির শ্বাসরোধ করা, যাতে জাতির উন্নতির জন্য কোনো ধারণা বা সংগ্রাম সৃষ্টি না হয়। এর ফলে, বহু বধ্যভূমি রয়ে গেছে, যা তাদের নিষ্ঠুরতার নীরব সাক্ষী হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ১৯৭২ সালে ‘নিউজউইক’ পত্রিকার নিকোলাস টমালিন একটি নিবন্ধে প্রায় ১,০৭০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা উল্লেখ করেছিলেন। তবে ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’-এ ২৩২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। তবে সেটি সম্পূর্ণ তালিকা নয় ।
প্রাথমিক তদন্ত
১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর (বা কিছু সূত্র অনুসারে ২৯ ডিসেম্বর) প্রথম আনুষ্ঠানিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিষয়ে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জহির রায়হান। প্রাথমিক তদন্তে এই কমিটি জানায় যে, মেজর জেনারেল রাও ফারমান আলী বাংলাদেশের প্রায় ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। জহির রায়হান মন্তব্য করেন, “তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করে নিধন করেছে।” তবে জহির রায়হান ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হওয়ার পর এই কমিটির কার্যক্রম থমকে যায়।
ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিষয়টি নিয়ে ন্যায়বিচারের সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, যখন প্রফেসর গিয়াসুদ্দিন আহমেদের বোন ফারিদা বানু রমনা থানায় আল-বদর সদস্য চৌধুরী মঈন উদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। কালপরিক্রমায় মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ার মধ্য দিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারসহ সমগ্র জাতির কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উত্তরাধিকার
বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা একটি অত্যন্ত শোকাবহ ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই মহান ব্যক্তিত্বদের জীবন কেবল তাদের পরিবারের জন্যই নয়, বরং পুরো জাতির জন্য একটি বিশাল ক্ষতি ছিল। এটি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক এবং একাডেমিক অগ্রগতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। এই ব্যক্তিত্বদের ত্যাগ আমাদের স্বাধীনতার মূল্য শিখায় এবং এর মাধ্যমে জাতির একতা ও আত্মমর্যাদার গুরুত্ব তুলে ধরে।
তাদের ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগ শুধুমাত্র বাংলাদেশের মুক্তির এক বিশাল মূল্য ছিল না, এটি বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও একটি বড় দায়িত্ব। তাদের জীবন ছিল জ্ঞান, ন্যায় ও অগ্রগতির জন্য নিবেদিত। তাদের অকাল মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দমন-পীড়নের মুখে এই আদর্শগুলো কতটা নাজুক। বাংলাদেশের সামনে এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, তাদের রেখে যাওয়া আদর্শগুলিকে রক্ষা করা।
তাই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উত্তরাধিকারকে সম্মান জানানোর মতো একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা আমার একান্ত দায়িত্ব। যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তা নিরাপদে বিকশিত হবে এবং যে আদর্শগুলোর পেছনে তারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেগুলোকে রক্ষা করে এবং একটি ন্যায়বিচারপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে জাতি তার এগিয়ে যাওয়ার পথ নির্ধারণ করবে। আর এ ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় নিষ্ঠুরতার মুখেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গণতন্ত্রকামী ন্যায়বাদী মৌলিক চিন্তাই আমাদের সকল প্রেরণার উৎসমূল হওয়া উচিত।
খুলনা গেজেট/এনএম